ফিঙ্গারপ্রিন্ট কী? ফিঙ্গারপ্রিন্ট কীভাবে কাজ করে?

কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থাই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। তালার নকল চাবি বানানো যায়, সেফস লক ভেঙে ফেলা যায় এবং অনলাইনে পাসওয়ার্ডও আগে বা পরে অনুমান করে বের করে ফেলা যায়। এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখার উপায় কী? বর্তমানে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুরক্ষিত পদ্ধতির একটি হলো বায়োমেট্রিক পদ্ধতি যেমনঃ ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রেটিনা স্ক্যান ও ফেস লক যা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে করেছে কয়েক ধাপ উন্নত এবং সুরক্ষিত। কিছুদিন আগেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট কেবল অপরাধী শনাক্তকরণের কাজে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবহার করতো৷ কিন্তু এখন সাধারণ মানুষও এটি তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য একে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। আজকাল স্মার্টফোন, এটিএম মেশিন, জাতীয় পরিচয়পত্র সহ কম্পিউটার ল্যাপটপেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে।


ফিঙ্গারপ্রিন্ট কী? ফিঙ্গারপ্রিন্ট কীভাবে কাজ করে?


ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর ইতিহাস

ফিঙ্গারপ্রিন্টের আধুনিক সংস্করণ ব্যবহার শুরু করেন, স্যার এডওয়ার্ড হেনরি। ১৯ শতকের শুরুর দিকে তিনি লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশে এটি ব্যবহার করেন। এখানে একটা বিষয় হয়তো অনেকেরই অজানা যে, এই ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কারক 'আজিজুল হক' নামের একজন বাংলাদেশী! গণিত বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা দেখে এডওয়ার্ড হেনরী আঙ্গুলের ছাপ গবেষণার জন্য আজিজুল হককে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন। তখন ফ্রান্সিস গ্যালটনের পুরোনো পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ হত, যা সময় সাপেক্ষ ও অকার্যকর ছিল। আজিজুল হক তার গাণিতিক দক্ষতার মাধ্যমে আঙ্গুলের ছাপের কিছু বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে ৩২*৩২= ১০২৪ টি খোপের মাধ্যমে শ্রেণীবিন্যাস করেন, যা অজানা আঙ্গুলের ছাপ বের করতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। হেমচন্দ্র বোস এই কাজে পুর্ণতা দিতে সাহায্য করেন এবং এ পদ্ধতির জানাজানি হয়ে গেলে হেনরি এডওয়ার্ড একে ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেন। যদিও পরে আসল বিষয়টি প্রকাশ পায়।


ফিঙ্গারপ্রিন্ট কী?

এককোষী জীব বা বহুকোষী প্রাণী থেকে অনন্ত মহাবিশ্ব সবকিছু একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনে চলে। আমাদের এই প্রকৃতি প্যাটার্নে পরিপূর্ণ। প্রকৃতির এই প্যাটার্নগুলো জানার ও বোঝার জন্য দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এই প্রাকৃতিক প্যাটার্ন গুলোকে গাণিতিক রুপ দেওয়া যায়, কখনও আবার নির্দিষ্ট নিয়ম, বিশদ বর্ণনা এবং চিহ্নিত করা যায়। প্রাকৃতিক এই বিষয়গুলো সার্বজনীন মৌলিক নীতি মেনে চলে এবং প্রকৃতি এই নীতি থেকে কখনও  বিচ্যুত হয় না।


ফিঙ্গারপ্রিন্টের ক্ষেত্রেও এই নিয়মটি প্রযোজ্য হবে। কারণ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর প্রথম মৌলিক বিষয়টি হলো এর অনন্যতা। কোনো একটি ফিঙ্গারপ্রিন্টের বৈশিষ্ট্য শুধু তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং দুইটি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গুলের ছাপ কখনো এক হবে না। এই বৈশিষ্ট্য এতোটাই ইউনিক যে, জমজদের মধ্যেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট আলাদা আলাদা হয়। জানা যায় যে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভ্রণের ষষ্ঠ মাসে গঠিত হয়।


ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর আরো একটি মৌলিক বিষয় হলো, ফিঙ্গারপ্রিন্ট আজীবন একই থাকে। অর্থাৎ এর কোনো পরিবর্তন হয় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আঙুলের ছাপের আকারে বড় হতে পারে, কিন্তু এর প্যাটার্ন সবসময় একই থাকে। তবে আঙ্গুলের কোনো ক্ষতি হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর গঠনের পরিবর্তন হতে পারে।


ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেখতে অনেক জটিল মনে হলেও এর মাঝে কিছু অনন্য প্যাটার্ন রয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্টে রিজ (ফিঙ্গারপ্রিন্টের উঁচু ঢাল) প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়, যাকে নিয়মতান্ত্রিক শ্রেণীবিন্যাস করা সম্ভব। এটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর তৃতীয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য।


ফিঙ্গারপ্রিন্টের মোট তিনটি মৌলিক রিজ প্যাটার্ন আছে। সেগুলো হলো-


১। Arches (আর্ক): এই টাইপের প্যাটার্নে রিজ এক দিক থেকে শুরু হয় এবং অন্য দিক থেকে শেষ হয়। পৃথিবীর মাত্র ৫% মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর্ক প্যাটার্নের হয়ে থাকে।


২। Loops (লুপস): এই টাইপের প্যাটার্নে রিজ যে দিক থেকে শুরু হয়েছে সেদিক দিয়েই শেষ হয়। পৃথিবীর প্রায় ৬০-৬৫% ভাগ মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এই প্যাটার্নের হয়ে থাকে।


৩। Whorls (ঘুর্ণি): এই প্যাটার্ন বৃত্ত দিয়ে গঠিত। এই প্যাটার্নে একটার বেশি লুপস অথবা প্যাটার্নের মিশ্রন থাকে। পৃথিবীর ৩০-৩৫% মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এই ধরনের হয়।


ফিঙ্গারপ্রিন্ট কীভাবে কাজ করে?

প্রায় বেশিরভাগ ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার একই ধরণের হার্ডওয়্যার নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। তবে বিভিন্ন অতিরিক্ত ফিচারস এবং সফটওয়্যার, প্রোডাক্ট এর পারফরম্যান্স এ বড় ভুমিকা রাখে এবং গ্রাহক পর্যায়ে কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে তাও নির্ধারণ করে।


ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারের সাথে এক বা একাধিক IC সংযুক্ত থাকে, যা স্ক্যানকৃত ডেটাকে বাইনারীতে রুপান্তর করে এবং তা মূল প্রসেসরে প্রেরণ করে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মূল পয়েন্টগুলো সনাক্ত করতে, একেক ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যানুফ্যাকচারার একেক রকমের ডেটা ব্যবহার করে, যা এর গতি এবং নির্ভূলতার ওপরেও প্রভাব ফেলে।


স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে Minutiae বা ক্ষুদ্র পয়েন্টগুলোর বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে একটা ম্যাপ তৈরী হয়। ম্যাপে এই পয়েন্টগুলোর আকার, আকৃতি, এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টের মধ্যবর্তী দূরত্ব, অবস্থান থেকে অ্যালগরিদম তৈরী করা হয়। যার ফলে প্রতিবার পুরো ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানের প্রয়োজন পরে না। ব্যবহারের সময় আঙ্গুলের কিছু পয়েন্টের স্ক্যান করে পূর্বের তৈরিকৃত ম্যাপের সাথে কতোটা সংগতিপূর্ণ তা মিলিয়ে দেখা হয়। এর ফলে ডেটা প্রসেসিং এ পাওয়ার সেভ হয় এবং আঙ্গুলে ময়লা থাকলেও রিডিং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমায় এবং স্ক্যানারের সঠিক স্থানে আঙ্গুল না রাখলেও বেশ ভালো ভাবে শনাক্ত করতে পারে।


আবার এই অ্যালগরিদম গুলো ডিভাইসে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হয়। যেসব ডেটা এই অ্যালগরিদমের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো থেকেও এই অ্যালগরিদমকে সুরক্ষিত রাখতে হয়। ইউজারের ডেটাকে অনলাইনের আপলোড করার বদলে, TEE (Trusted Execution Environment) ভিত্তিক ট্রাস্টজোন টেকনোলোজির মাধ্যমে প্রসেসরে অ্যালগরিদমকে চিপে এনক্রিপ্ট করে রাখা হয়। ফলে OS বা কোনো অ্যাপস অ্যালগরিদমের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। TEE অংশটি অন্যান্য ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রসেসের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয় এবং এটি সরাসরি প্রসেসর থেকে হার্ডওয়্যার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডারের সাথে ডেটা আদান প্রদান করে।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন